1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  4. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  5. shanto.hasan000@gmail.com : Rakibul Hasan Shanto : Rakibul Hasan Shanto
  6. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  7. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  8. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :

রাজনীতির বাইরে কেমন ছিলেন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু? — নাইম ইসলাম নিবির

  • Update Time : শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ২৭৩ Time View

রাজনীতির বাইরে কেমন ছিলেন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু? 

— নাইম ইসলাম নিবির। 

ইদানিং ঘুমের কোনও সময় অসময় বুঝে উঠতে পারছি না। যখন তখন ঘুম থেকে জেগে উঠছি। আর সম্বিত ফিরে পেতেই হাপাচ্ছি বলে মনে হতে থাকে। লিখালিখি আর ব্যক্তিগত কার্যক্রমের জন্য আমি খুব তারাতাড়ি ঘুমোতে যাই এবং রাত ৩ বা ৪ টার সময় জেগে উঠি।  বরাবরের মতো গত রাতেও ঘুমিয়ে ছিলাম এবং অন্যান্য দিনের চাইতে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে রীতিমতো হতাশা আর বিস্বাদগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। বার্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপট আর চারদিকে স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কথা মনে করে আমি রীতিমতো হাপাতে লাগলাম। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা খুব মনে পড়ে গেল। আর নিজ মনে ভাবতে লাগলাম তুমি ছাড়া তরুণ রাজনীতিবিদদের খোঁজ নেবার লোকের খুবই অভাব বঙ্গবন্ধু। তাই ভারাক্রান্ত মনে হাপাতে হাপাতে একসারি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আজকের কলামটি রচনা করতে চললাম। আর ভাবতে লাগলাম আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি আমার আজকের কলামটি পড়ে নিশ্চিত কাছে ডেকে নিতেন আর্শীবাদপুষ্ট করতেন মূল্যায়ন করতেন। এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিতেন।

সম্মানিত পাঠক! আমার দুঃখের কথা আর না বাড়িয়ে চলুন আপনাদেরকে আজ নতুন করে বঙ্গবন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা আপনারা সবাই জানেন। তবে রাজনীতির বাইরে এই মানুষটি কেমন ছিলেন সেটি নিয়ে আমরা আজকে আলোচনা করবো। একবার এক ভদ্রলোক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার সন্তানরা বড় হয়ে কী হবে বলে আশা করছেন?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি চাই, আমার সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠুক। এ-ই হলেন শেখ মুজিব। এ প্রশ্নের জবাবে জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খানিকটা ফুটে ওঠে। তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি বললেন, ওরা যে যার ক্যারিয়ার নিজেদের পছন্দমতো বেছে নেবে। আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন অমায়িক, বিনয়ী ও সুবিবেচক মানুষ। তাঁর আচরণ অত্যন্ত আন্তরিক। তাঁর সর্বদা সৌম্য মুখখানা সহজেই উদার হাসিতে ভরে যায়। তাঁর রসবোধ তাঁকে জীবনের যত যন্ত্রণা ও মামলা-মোকদ্দমা থেকে রক্ষা করেছে। তার যে জিনিসটি সবচেয়ে অবাক করে তা হলো দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস। একবার যদি মনস্থির করেন যে তিনি ঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন, পথে যতই বাধাবিপত্তি আসুক না কেন সব ঠেলে এগিয়ে গেছেন সামনে। ভিড়ের মধ্যে সহজেই তিনি নজর কেড়ে নিতেন। যেখানেই থাকুক, সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষক হয়ে উঠতেন বঙ্গবন্ধু। তরুণকালের লম্বা, রোগা শরীরটি থেকে তাঁর রূপান্তর ঘটে এক দারুণ ব্যক্তিত্বময় নেতায়।

বঙ্গবন্ধু যখন জনতার মাঝে দাড়িয়ে তাদের উদ্দেশে প্রবল ও শক্তিশালী কণ্ঠে সরকারের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ভাষণ দিতেন, তখনো আসল মানুষটিকে ঠিক চেনা যেতো না। কাছাকাছি এলে বোঝা যেতো, বঙ্গবন্ধু আচরণে কতটা আন্তরিক, ঘরোয়া ও সংবেদনশীল ছিলেন, যার মুখে প্রায়ই ফুটে থাকতো হাসি। তবে তাকে কেউ বোকা বানাতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু নতুন নতুন আইডিয়া পছন্দ করলেও আগের আইডিয়াগুলো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে না দেখে তা বাতিল করেন না।

শেখ মুজিবের জীবনযাপন কৃচ্ছসাধনের এক অতি সাধারণ জীবন। আরাম- আয়েশ, ভোগবিলাস ইত্যাদির প্রতি তার কোনো মোহ ছিলো না বলেই তিনি আজ সফল বিশ্বনেতাদের একজন। বাড়ি, টাকা, আরাম-আয়েশ ইত্যাদির প্রতি এ ঔদাসীন্য তাঁর প্রতি লোকের শ্রদ্ধা ও সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ । জীবনের প্রতি তাঁর পদক্ষেপ ছিলো সাধারণের চেয়ে দ্রুত ও প্রবল।

যেসব মানুষ শেখ মুজিবের সান্নিধ্যে আসতেন তাদের মধ্যে তিনি ছড়িয়ে দিতেন নিজের প্রবল ব্যক্তিত্বের কারিশমা। তিনি মঞ্চে বক্তৃতা করার সময় স্পষ্ট, সরল ভাষায় ভাষণ দিতেন এবং মাঝে মাঝেই মজার মজার টীকা-টীল্পনী যুক্ত করতেন। মানুষকে এই যে সংবেদনশীল এবং কুশলী হাতে সামলানোর ক্ষমতা, এটি বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। তাঁর মাঝে একগুয়ে ও প্রচণ্ড তেজস্বী যে ভাব ছিলো তা খুবই বিরল। শেখ মুজিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে জিদ্দি ও স্পর্ধিত একটি ব্যাপার ছিলো।

একগুঁয়ে স্বভাবের হলেও তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল একজন মানুষ। তার ভেতরে জেদ ও ক্ষমতার এক আশ্চর্য মিশেল ছিলো। বঙ্গবন্ধু মানুষকে ক্ষমা করে দিতেন এবং মানুষদের অপরাধের কথা ভুলে যেতেন। যেসব সাবেক রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো প্রতিহিংসা ছিলো না। কিংবা বঙ্গবন্ধু তাদের অমঙ্গল কামনাও করেনি কখোনও।

আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতি ভেবেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব শেষ হয়ে যাবেন এবং অন্তত ২০ বছর জেলের ঘানি তো তাকে টানতেই হবে। সেই লোকটি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটালেও পরবর্তীতে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগ অফিসে যাতায়াতও শুরু করেছেন। মুজিব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় মনে করলো তিনি বুঝি অতীতের কথা একদমই ভুলে বসে আছেন। যদিও এর আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন, ‘এই লোকটিকে আমি আবার আওয়ামী লীগে অ্যালাউ করব না।

জন গুনথার বলেছিলেন জেলখানার একাকিত্ব উপভোগ করতেন গান্ধীজি। তিনি ধ্যান করতেন এবং ঈশ্বরধ্যানে মগ্ন থাকতেন। শেখ মুজিবেরও কোনো রকম জেল ভীতি ছিল না। বলা চলে, জেলখানা ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় আবাস। একদিন তিনি একজনকে বলেই ফেলেছিলেন, ‘কারাগার আমার আরেক বাড়ি। তবে কারাগারের জীবন তার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। বাইরে অনেক কাজ পড়ে আছে বলে কারাগারে অন্তরীণ থাকাকে তিনি স্রেফ সময়ের অপচয় ভাবতেন। তাঁর মতে, “নির্জন কারাবাস সরকারের সবচেয়ে জঘন্য শাস্তি।’ তাঁকে জেলঘুঘুও বলা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে জেলখানায় তাকে নয় বছর আট মাস বন্দি থাকতে হয়েছে। যে-কোন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের জন্য এটি ছিল দীর্ঘতম কারাবাস।সরকার বদল হলেই সরকারের প্রথম শিকার হতেন শেখ মুজিব। তাঁকে জেলে ঢোকানো যেন সরকারের নৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পরে তাঁকে মওলানা ভাসানী ও আবুল মনসুরের সঙ্গে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। প্রথম রাতটি তারা একত্রে কাটান এবং সারা রাত কথা বলেই পার করেছেন সময়। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক গেট-টুগেদার। তারা রাজনীতি ও সামরিক শাসনের ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরদিন তাদের আলাদা সেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

শেখ মুজিবের মতো হাসিখুশি, সঙ্গলিলু মানুষের জন্য এটি ছিল নির্যাতনের সামিল। অন্যান্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো তিনিও জেলখানায় থিতু হয়ে যান বই পড়ে, সবজি ও ফুলের বাগান করে। জেলের আরেকটি ওয়ার্ড থেকে একটি আমগাছের চারা সংগ্রহ করে তিনি সেটি নিজের সেলের পেছনের আঙিনায়। লাগিয়ে ছিলেন। চারা রোপণ করার সময় তিনি জেল সুপারিনটেনডেন্টকে বলেছিলেন, ‘আমি এ জেলখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই এই গাছের আম খেয়ে যেতে চাই।’ রসিকতার ভঙ্গিতে কথাটি বলা হলেও তার বলার ঢঙে মনের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছিল তা জেল সুপারিনটেনডেন্টকে অভিভূত করে। শেখ মুজিব কেবল সাহসীই ছিলেন না, তাঁর আত্মাটি ছিল গ্র্যানাইট পাথরের মতো দৃঢ় ও শক্ত।

অতীতে যতবার তিনি জেলে গেছেন, পাঁচ সন্তানকে কোথায়, কার কাছে রেখে যাবেন তা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তবে ঢাকার ধানমন্ডিতে বাড়ি করার পরে পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাই হয়েছে ভেবে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।একদিন তিনি বলেন, ‘সামরিক আইন জারির পরে আমার বন্ধুরাও আমাকে ঘর ভাড়া দিতে সাহস পায়নি।’ এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাড়া করে ফিরেছে তাঁর স্ত্রীকে। সেই অনিশ্চিত, দুর্দশাময় দিনগুলোতে তাকে একের পর এক বাড়ি বদল করতে হয়েছে। ঢাকায় একটি স্থায়ী ঠিকানা হবার পর পরিবারের জন্য তাঁকে আর দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আপনজনদের কোন পীড়া না দিয়েই তিনি এখন যে-কোন ঝুঁকির মধ্যে ঝাপিয়ে পড়তে পারবেন।

তিনি ধানমন্ডির বাড়ির বৈঠকখানাটি কালেভাদ্রে ব্যবহার করেন। যেকেউ সহজেই তাঁর সামনের বেডরুমে ঢুকে যেতে পারতেন। ওখানে তিনি পিঠ খাড়া চেয়ারে কিংবা বিছানার এক কোণে বসতেন। দর্শনার্থী দেখলে মুখে অভ্যর্থনার হাসি ফুটিয়ে উঠে দাঁড়াতেন এবং হেঁটে গিয়ে তাকে স্বাগত জানাতেন, তাঁকে আলিঙ্গন করে চেয়ারে বসতে দিতেন।

বঙ্গবন্ধু সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। তবে শুধু ঐতিহাসিক ছবি। তিনি বলেন, ‘আমি দুই-তিন বছরে একটি বা দুটির বেশি ছবি দেখার সুযোগ পাইনি। সম্প্রতি সামরিক আইন জারির পরে তিনি ঐতিহাসিক ছবি সিরাজউদ্দৌলা দেখেছেন। যদিও এই সিনেমাটি দেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের।

বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর প্রিয় বইয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলতেন, “নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ, কেনেডি এবং মাও সে তুংয়ের লেখা আমার ভালো লাগে।’ বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মস্ত ভক্ত ছিলেন। কেনেডিকে মানুষ হিসেবে তাঁর খুব পছন্দ ছিলো। কেনেডির একটি উদ্ধৃতি বঙ্গবন্ধুর বিশেষ পছন্দ, দেশ তোমাকে কী দিতে পারে তা জানতে চেয়ো না, বরং তুমি দেশের জন্য কী করতে পারবে নিজেকে সে প্রশ্ন করো।

তার পছন্দ-অপছন্দের তালিকাটি বেশ বিস্তৃত ও পরিশীলিত। তবে জেলায় জেলায় বক্তৃতা প্রদান কিংবা দর্শনার্থীদের সময় দিতে হয় বলে বই পাঠের সময় বঙ্গবন্ধু খুব কমই পেতেন।তার বাড়ির লাইব্রেরিতে দুই আলমারি বোঝাই শুধু বই- চার্চিল, কার্ল মার্কস থেকে শুরু করে বাংলার ইতিহাস, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসসহ কেনেডি ও বারট্রান্ড রাসেলেরও প্রচুর বইয়ের কালেকশন ছিলো।

ইসলাম ধর্মের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিলো অত্যন্ত প্রখর। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন মুসলমান। এ কথার মাধ্যমে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আত্মবিশ্বাস এবং মনের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস। মূলের প্রতি কারো গভীর বিশ্বাস থাকলেই কেবল এটি সম্ভব।তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের চেয়ে বরং ইসলামের মৌলিকত্বে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ভীত এ কথা ভেবে যে বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত আচার অনুষ্ঠানগুলো নবীজির ইসলামকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে, যা মুসলমানদের ভুলপথে চালিত করতে পারে ।

তিনি প্রসঙ্গত একবার বলেন, আমার স্ত্রী বড্ড বেশি মিতব্যয়ী ও সাবধানি, তিনি সব সময় দুর্দিনের জন্য প্রস্তুত থাকেন। সংসার নামের রণাঙ্গনটি চালানোর সমস্ত কর্তৃত্ব আমি তাঁকে দিয়েছি। তার চোখে ফুটে ওঠে কৌতুক, ‘আমি যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন চাই তেমনি গৃহপ্রশাসন চালাতে আমার স্ত্রীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দিয়েছি। তার স্ত্রী প্রসন্ন মেজাজের এক মহীয়সী নারী। একজন বাঙালি মায়ের সমস্ত গুণই তার মাঝে বিদ্যমান। তিনি কোমল, স্নেহময়ী ও দয়াবতী। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের দিল খুলে সাহায্য করতেন। এই মহীয়সী নারীটির রসবোধও ছিলো অত্যধিক প্রবল। সামরিক শাসন জারির কয়েক দিন পরে তিনি মন্তব্য করেন, মার্শাল ল হয়ে ভালাই হয়েছে। আমি এখন ওনার সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগ পাই। নইলে তো উনি সারাক্ষণই দর্শনার্থী দ্বারা ঘিরে থাকেন। তারা রাত ১২টা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকে, আবার ভোর হতেই তার কাছে চলে আসে। ‘আর্থিক দুঃসময়ে তিনি স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। দুর্দশা ও ভোগান্তির সময়ে সর্বদা তার পাশে এসে দাড়িয়েছেন। শেখ মুজিব যখন-তখন বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছেন কারণ তিনি জানতেন তাঁর স্ত্রী দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠায় কাবু হবেন না। মুজিবের আত্মত্যাগের পেছনে তার স্ত্রীর আত্মত্যাগও কম নয়, যিনি বছরের পর বছর দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ সয়ে গেছেন। মুজিব জেলে গেলে তিনি জানেন না, কবে তার স্বামী জেল থেকে ছাড়া পাবেন। স্বামীর চিন্তা এবং তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতি বিশ্বাসই ছিল মহীয়সী এ নারীর শক্তির একমাত্র উৎস।

শেখ মুজিব তাঁর স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। জেলে গেলে মুজিব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নন, কারণ তিনি জানেন, ছেলেমেয়েদের নিরাপদ হাতে রেখে যাচ্ছেন। তিনি ভাবেন, তাঁর স্ত্রী একজন স্নেহশীলা ও দয়াময়ী নারী। তবে যে ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে আকর্ষণ করতো তা হলো তার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত সাহসী।’ অতীতে পুলিশ এসে যখন তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে পুরে দিতো, তাঁর স্ত্রী কখনো চোখের পানি ফেলতেন না এবং ভেঙে পড়ার কোন চিহ্নও দেখাতেন না। তিনি কি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় কান্নাকাটি করেছিলেন? এই প্রশ্নে মুজিব বলেন, কান্নাকাটি করে আমি জানি না। হয়তো আমার আড়ালে কেঁদেছেন। আমি ঠিক বলতে পারব না।

শেখ মুজিব তার এক চাচার দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে করেন। এরকম একজন জীবনসঙ্গিনী পেয়েছেন বলে তিনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। মুজিবের পিতা-মাতা এ বিয়ের আয়োজন করেন। তাদের বিয়েটি ছিল অত্যন্ত সফল এবং পাত্র-পাত্রী হিসেবে দুজনেই ছিলেন উপযুক্ত। দৃশ্যত দুজনকে মনে হয় আলাদা। মিসেস মুজিব মৃদুভাষী, চুপচাপ আর শেখ মুজিব তাঁর উল্টো। তিনি অত্যন্ত উষ্ণ, বন্ধুপরায়ণ এবং ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরাই তাঁর পছন্দ। তবু তারা সাহস ও জনদরদি চেতনায় একই বন্ধনে গ্রন্থিত।

দলীয় কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত সম্মান ও বিনয় নিয়ে ‘মুজিব ভাই সম্বাধন করে। ফজলুল হক তাকে নাতি বলে ডাকতেন আর সোহরাওয়ার্দী তাকে নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। একজন মার্কিন সাংবাদিকের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার দলের মানুষদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নই। আমি শ্রেফ মুজিব ভাই।

পরিবার, জনগণ ও রাজনীতির বাইরে মুজিবের আরেকটি ভালোবাসার জায়গা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চল । তিনি একবার তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, আমার যদি গ্রামের রাস্তার ধারে একটি বাড়ি থাকত। তাহলে রাজনীতি থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থেকে সবুজ প্রকৃতি দেখতাম মন ভরে। জীবন ও রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন নিয়তিবাদী। সকলেরই দরকার হবে কয়েক হাত জমি।”আপনি কি মৃত্যুর কথা মাঝে মাঝে চিন্তা করেন? জিগ্যেস করলে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমি সব সময়ই মৃত্যুর কথা ভাবি।’

খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোন খুঁতখুতি ছিলো না শেখ মুজিবের। প্রিয় খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন ‘আমি কিন্তু সাদা ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা খেতে সবচেয়ে পছন্দ করি। মাছের ঝোলও তার বেশ পছন্দ। শেখ মুজিব বাস্তব উপলব্ধির ক্ষমতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। বইপত্র পড়ে কিংবা বিমূর্ত কিছু থেকে তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টি আসেনি, এসেছে বেকার যুবকদের হতাশা, কৃষকদের অসহায়ত্ব, তাদের সন্তানদের ক্ষুধা ও অসুস্থতা দেখে। বুদ্ধিবৃত্তির চেয়েও অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর প্রধান শক্তি। অলস, অদক্ষ ও আবেগনির্ভর আদর্শবাদীদের তিনি পছন্দ করেন না। এদের নির্বুদ্ধিতা তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলতো।  তিনি তাঁর সহকর্মী, সেক্রেটারি কিংবা ভূত্যদের সঙ্গে চেঁচামেচি করলেও কিছুক্ষণ পরেই তা ভুলে যান। এ গুণটি তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মাঝেও ছিল। বিশ্বস্ততা ও কৃতজ্ঞতা দুটি ভাল রাজনৈতিক অস্ত্র, তিনি এটি বিশ্বাস করতেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের লক্ষ্য ছিলো মানুষের মঙ্গল করা। তিনি সর্বদা বলতেন, ‘আমি স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের জন্যই। আমার চোখে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গরিব মানুষদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পরে বঙ্গবন্ধু আগের চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলেন। এই ভেবে যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানিদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে পেরেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত অহংকার এবং গর্ব বুকে ধারণ করেও তিনি কিন্তু হীনম্মনা এবং অন্তর্মুখী জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। আইয়ুব সরকার যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গান বাদ দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন সংকুচিত করার চেষ্টা করেছিল, শেখ মুজিব তখন ঘোষণা করেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালি কবি নন, তিনি বিশ্বকবি। লোকে যেমন শেক্সপিয়র, অ্যারিস্টটল, কার্ল মার্কস পড়তে চায়, তেমনি তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাও পাঠ করতে চায়।

তিনি নিদারুণ সব দুর্দশায় পড়েছেন, তার পরও আশাবাদ ছাড়েননি। সব সময়ই অনুভব করেছেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নিয়তির একটি উপাদান। একবার তিনি আপনমনেই বলছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় হয়তো আমার ২০ বছরের জেল হয়ে যাবে। মামলার বিষয়টি বিবেচনা করে যদি দণ্ড মওকুফ করাও হয়, আমি যখন জেল থেকে বেরিয়ে আসব তখন আমার বয়স হবে ৬৪। যদি তখনো আমার লোকদের শোষণ বন্ধ না হয় এবং আমার ছয় দফা অর্জিত না হয়, আমি এর জন্য লড়াই করে যাবো।

বঙ্গবন্ধুর জীবন বিশ্লেষণ করলে শেখা যায় “সাহস সেরকম একটি জিনিস নয়, যা কোন মানুষ একটিমাত্র কাজ করেই অর্জন করতে পারে। সারা জীবন এই সাহসকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।”

 

নাইম ইসলাম নিবির: রাজনীতিক ও কলামিস্ট।

nayemulislamnayem148@gmail.com 

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..